
আগৈলঝাড়ার রক্তমাখা সন্ধ্যা আর এক কিশোরের শেষ নিঃশ্বাস
২১ এপ্রিল ২০২৫। সূর্য তখন মাগরিবের আগে পশ্চিমের আকাশে ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে পড়ছে। বরিশালের আগৈলঝাড়ার সাহেবের হাট এলাকাটি তখন আর পাঁচটা দিনের মতোই ছিল শান্ত-স্নিগ্ধ। কিন্তু হঠাৎই সেই নিরবতা চিরে এলো গুলির শব্দ। ছুটে এলো কান্নার মাতম। আর হারিয়ে গেলো এক তরুণের স্বপ্ন। কয়েক সেকেন্ডেই শেষ হয়ে গেল ছিয়াম মোল্লার জীবন।
মৃত্যুর পরে পাল্টে যায় ছিয়ামের পরিচয়?
মাত্র ১৭টি বসন্ত পাড় করা ছিয়াম উজিরপুর উপজেলার বাহেরঘাট এলাকার রিপন মোল্লার ছেলে ও কারফা আইডিয়াল কলেজের এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। মাদক তো দূরের কথা, ছেলেটি কখনো থানায় গিয়েছিল কি না, তা নিয়েও নিশ্চিত হতে পারছে না পরিবার। কিন্তু সেই দিনই প্রথম তার নাম উঠে আসে “মাদক কারবারি” হিসেবে। কে দিলো এই পরিচয়? কারা সিদ্ধান্ত নিল যে তার বুক চিরে গুলি চালানোই ন্যায্য বিচার?
রক্তমাখা বিকেল: প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য
ঘটনার সঠিক চিত্র এখনো কুয়াশায় ঢাকা। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, সাদা পোশাকে থাকা র্যাব সদস্যরা গিয়েছিলেন মাদকবিরোধী অভিযানে। স্থানীয়দের চোখে তারা ছিলেন অপরিচিত। ছিনতাইকারী বলে সন্দেহ হওয়াতেই শুরু হয় তর্কবিতর্ক। তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে উঠে এসেছে নির্মম দৃশ্য। এক চায়ের দোকানের পাশে, রুবেল মোল্লা নামের এক যুবককে টানা-হেঁচড়া করছিলেন অচেনা দুই ব্যক্তি। রুবেল চিৎকার করে বলেন, “ওরা ছিনতাইকারী!” চারপাশে মানুষ জমে যায়। শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি, উত্তেজনা। এবং তারপর, পিস্তল বের করে গুলি। সেই গুলি লাগে ছিয়ামের বুকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। তার ফুফাতো ভাই রাকিব গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে পাশের নালায়। পালিয়ে বাঁচে রুবেল, কিন্তু বাঁচে না ছিয়াম ।
একটা মৃত্যু, দুইটা বয়স, আর অজস্র প্রশ্ন
হাসপাতালের রেকর্ডে ছিয়ামের বয়স লেখা হয়েছে ২২ বছর। অথচ জন্মসনদ বলছে সে জন্মেছে ২০০৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। তার মানে শিশু আইন অনুযায়ী ১৭ বছরের কিশোর ছিয়াম এখনো নাবালক। তবে কি হাসপাতাল ভুল করেছে? নাকি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বয়স বাড়িয়ে ছিয়ামকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রমাণ করা হচ্ছে?
র্যাব বলছে, ছিয়াম ছিলেন মাদক ব্যবসায়ী এবং ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয়েছে ৩৯৩ পিস ইয়াবা। এদিকে থানার ওসি জানালেন, ছিয়াম ও রাকিবের নামে পূর্বে কোনো মাদকের অভিযোগ ছিল না। জনমনে প্রশ্ন মাদক ব্যবসায়ী কি তার পকেটে ইয়াবা রেখে জনসম্মুখে ঘুরে বেড়ায়? আর যদি ছিয়াম ইয়াবা ব্যবসায়ীই হন, তাহলে তার নামে আগের কোনো মামলা ছিল না কেন? তাহলে র্যাব কাদের আটক করতে গিয়েছিল? গুলিই বা কেন? আর, যদি সত্যিই আত্মরক্ষার জন্য গুলি চালানো হয়, তাহলে কেন ঘটনার পরপরই স্থান ত্যাগ করেছিলেন অভিযানে থাকা সদস্যরা? র্যাব এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। তবে ঘটনার পরপরই দুটি মামলা করেছে একটি মাদক উদ্ধার এবং আরেকটি সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগ। এর একটিতে র্যাব সদস্যরা আহত হওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও ছিয়ামের মৃত্য ও রাকিবের আহত কিংবা গ্রেপ্তারের তথ্য অস্পষ্ট। তাহলে ছিয়ামের দেহে বিদ্ধ গুলিটি ছুঁড়েছিল কারা? সে উত্তর আজও ঝাপসা।
পরিবার: নিঃশব্দ কান্না ও নিরুত্তর শোক
ছিয়ামের পরিবার এখন পুরুষশূন্য। তাদের বাড়িতে কেবল নারীরা। বিধ্বস্ত মা, জড়োসড়ো বোনেরা, স্তব্ধ উঠোন। একান্নবর্তী সেই ঘর, এখন যেন এক শূন্য প্রহরঘর। কে যাবে, কে বলবে, ছিয়াম কী ভুল করেছিল?
ছিয়ামের চাচাতো বোন মীমের আহাজারি, “আমার ভাই কি মাদক বিক্রি করত? ভাই তোর বইয়ের ব্যাগটা তো এখনো খোলা…। ও তো শুধু রুবেলকে নিয়ে গণ্ডগোল হচ্ছিল, সেটা দেখছিল। সে কারো গায়ে হাত তোলে নাই, শুধু দাঁড়িয়ে ছিল।” এই দাঁড়িয়ে থাকা’র শাস্তি কি গুলি হয়ে বুক চিরে আসা?
“সন্তানটা কি অপরাধ করেছিল?” কান্নায় ভেঙে পড়েন গুলিতে আহত রাকিবের মা মর্জিনা বেগম বলেন, “কারও সঙ্গে রুবেলের ঝগড়া হচ্ছিল। রুবেলের পক্ষ নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে শুধু কয়েকটা কথা বলেছিল রাকিব, তাই গুলি খেতে হলো তাকে”। এদিকে যাকে নিয়ে ঘটনা সেই রুবেল এখন পলাতক। বাড়িতে শুধু তার মা আনোয়ারা বেগম ও দুই বোন। বোনরা বললেন, “ঢাকায় চলে গেছে রুবেল। কী হয়েছে, আমরাও জানি না ঠিকমতো।”
একটা গুলি, একাধিক ব্যাখ্যা, কোনটা সত্যি?
র্যাব বলছে, একজন পুকুরে ফেলে দিয়েছিল তাদের এক সদস্যকে, সেখান থেকেই চলে আসে গুলি। কিন্তু ছিয়ামকে পুকুরে দেখা যায়নি। বরং সে দাঁড়িয়ে ছিল দূরে। এমনটাই বলছে প্রত্যক্ষদর্শীরা। তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, র্যাব, জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ বলছে “সত্য উদ্ঘাটন হবে।”
তবে তদন্তের ফাইল যতই ঘুরুক, জনমানুষের মনে প্রশ্ন জিইয়ে আছে ‘কেন মারা গেল এক কিশোর?’ ‘কারা গুলি চালাল?’ ‘র্যাব কি নিয়ম ভেঙেছিল?’ নাকি এমন বহু ঘটনার মতো এখানেও কি সত্য চাপা পড়ে যাবে কোনো অভিযানিক ব্যর্থতা’র ছায়ায়? তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই উত্তরগুলো শুধু অনুমান, কল্পনা, কিংবা শোকগাথা হয়ে রয়ে যাবে।
ছিয়াম কি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিল, নাকি সময়টাই তার সঙ্গে অন্যায় করেছিল?
গৌরনদী, আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর উপজেলার আনাচে-কানাচে রয়েছে চিহ্নিত রাঘব বোয়াল মাদকের গডফাদার। যাদের নামে ঝুলছে একের পর এক মামলা। যাদের পরিচয় জানে প্রশাসন, জানে জনগণ, জানে সময়। তবে কেন ছিয়াম? যে কিশোরের জীবনের পাতা এখনো লেখা শেষ হয়নি, তার বুক চিরেই কেন বেরিয়ে গেল সেই গুলিটা? কেন গুলিটা ছুটে গেল না সেই গডফাদারদের দিকে, যারা সত্যিকার অর্থেই সমাজকে পচিয়ে দিচ্ছে?
তবে ছিয়াম কি ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিল, নাকি সময়টাই তার সঙ্গে অন্যায় করেছিল? নাকি একটি নষ্ট ব্যবস্থার প্রতীক যেখানে অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়, আর বলির পাঁঠা হয়ে ওঠে এক নিরপরাদ কিশোর? এই প্রশ্ন এখন জনমনে গেঁথে আছে কাঁটার মতো। উত্তরের অপেক্ষায় তিন উপজেলার লাখো মানুষ।
প্রিয় পাঠক,
“যে গুলিটা ছিয়ামের বুক চিরে গেল, সেটি কি কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পেরেছে?” না! আজও সময়ের দেয়ালে সেই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি,অমীমাংসিত, অস্পষ্ট অথচ তীব্রভাবে জীবন্ত। গুলিটি কেবল একটি বুক চিরে যায়নি, চিরে দিয়েছে একটি সম্ভাবনাময় জীবনের কাঁচা স্বপ্ন, ছিঁড়ে দিয়েছে মায়ের আঁচল, স্তব্ধ করে দিয়েছে এক কিশোর হাসি। শব্দহীন সেই বিকেলে যখন ছিয়াম পড়ে ছিল রক্তাক্ত মাটিতে, তখন তার নিঃশ্বাস আর শরীরের ঘ্রাণে মিশে ছিল কাঁচা তারুণ্যের গন্ধ আর মুখে শেষবারের মতো উচ্চারিত হয়েছিল “আমার কিছু হয়নি”। সে কি নিজেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছিল? নাকি গলা তুলে গোটা সমাজকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিল, “কী ছিল আমার দোষ?”
সে যেন বলতে চেয়েছিল, “আমি তো কিছু করিনি…”। কিন্তু তার বলার আগে গুলিটাই যেন দিয়ে ফেলেছিল উত্তর। সেই চেরা বুকে আজও যেন নিঃশব্দ আর্তনাদ “আমার বিচার হবে তো?”
More Stories
আগৈলঝাড়ায় পল্লী চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় এক রোগীর গুরুতর অবস্থা
রাজাপুরে অজ্ঞাত যুবকের মরদেহ উদ্ধার, পরিচয় শনাক্তে সিআইডির অনুসন্ধান
গৌরনদীতে আগুনে পুড়ে ছাই স্বপ্নের ঘর